একটি অশ্রুভেজা যাত্রা / জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে
জীবনের কিছু মুহূর্ত এমন থাকে, যা আমাদের চিরদিনের জন্য বদলে দেয়। আজ তেমনই এক দিন আমার জীবনে। আমার ছোট্ট সোনামণি অসুস্থ, আর আমরা যাচ্ছি বরিশালের শেরে-ই বাংলা মেডিকেল হাসপাতালে। বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শূন্যতা, মনের এক কোণে ভয় আর অন্য কোণে অগাধ ভালোবাসা। চরফ্যাশন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যখন ডাক্তার বললেন, “আপনাদের বরিশাল যেতে হবে, এখানকার চিকিৎসার চেয়ে ওখানে আরও ভালো ব্যবস্থা পাওয়া যাবে,” তখন আমার মনের ভেতর যেন ঝড় বয়ে গেল। চিন্তার ভারে আমার কপাল ভাঁজে ভাঁজে ঢাকা পড়ল। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সিদ্ধান্ত নিলাম—এক মুহূর্তও অপেক্ষা করা যাবে না। ৪০০০ টাকা দিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স রিজার্ভ করলাম। জীবনে এই প্রথম অ্যাম্বুলেন্সে উঠলাম। ভেতরের পরিবেশের ভারী শূন্যতা, দ্রুত ঘুরতে থাকা সাইরেনের শব্দ—সবকিছু মিলিয়ে এক ভীষণ অচেনা অভিজ্ঞতা। তবে আমার মন ছিল এক জায়গাতেই—আমার সোনামণি। ওর প্রতিটি নিঃশ্বাস যেন আমার কাছে জীবন হয়ে উঠেছে। ওর দিকে তাকালেই আমার চোখ ভিজে উঠছে নোনা জলে। এত কান্না আমার জীবনে আগে কখনো হয়নি, অথচ আজ বারবার চোখের জল আটকাতে পারছি না। আমার মা পাশে ছিলেন। তিনি যেন আমার শক্তির একমাত্র উৎস। তার কোমল স্পর্শে সোনামণিকে মুড়ে রাখছিলেন, যেন ঠান্ডা না লাগে। তার এই যত্ন আর ভালোবাসা দেখে মনে হলো, মায়েরা আসলেই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। আমি যেন তার কাছ থেকে শিখছি কীভাবে আমার সন্তানকে আগলে রাখতে হবে। প্রায় দেড়-দুই ঘণ্টা পর আমরা ভেদুরিয়া লঞ্চঘাটে পৌঁছালাম। সেখান থেকে সাড়ে তিনশো টাকায় একটি স্পিডবোটে উঠলাম। স্পিডবোটের ৩০-৪০ মিনিটের যাত্রা যেন এক অনন্তকাল মনে হচ্ছিল। নদীর বাতাস, পানির শব্দ—এসব আমার কাছে একেবারেই অর্থহীন। আমার মন কেবলই স্যালাইনের দিকে, বারবার দেখে নিচ্ছি স্যালাইন ঠিকঠাক চলছে কিনা। এই পুরো যাত্রায় বারবার মনে হচ্ছিল, জীবন কতটা অনিশ্চিত আর ভঙ্গুর। আমার ছোট্ট সোনামণি, যে পৃথিবীর আলোয় এসেছে খুব বেশি দিন হয়নি, তার এমন অবস্থা আমাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিচ্ছিল। তবু মনের গভীরে একটা আশা ছিল, আল্লাহ আমাদের দেখবেন। বরিশাল পৌঁছানোর পর মেডিকেল চত্বরে পা রাখতেই মনে হলো, এক অজানা পরীক্ষার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছি। ডাক্তার, নার্স, আর চারপাশের সবকিছু যেন আমার মনের অস্থিরতাকে আরও তীব্র করে তুলছিল। তবুও আমি প্রার্থনা করছিলাম—আমার সোনামণি যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে, সন্তানের জন্য একজন বাবা-মা কী করতে পারে। আমি জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এই যাত্রা মনে রাখব। মায়ের ভালোবাসা, বাবার দায়িত্ব, আজ প্রায় চার দিন ধরে আমরা বরিশাল শেরে-ই বাংলা মেডিকেল হাসপাতালে অবস্থান করছি। এই চার দিন যেন আমার জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়। ক্ষণে ক্ষণে হাসপাতালের করিডোরে ভেসে আসা প্রিয়জনদের আর্তনাদ আর বুকফাটা কান্নার শব্দ আমার হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দিচ্ছে। প্রতিটি শব্দ আমাকে আরও ছোট, আরও তুচ্ছ, আরও অসহায় করে তুলছে। মনে হচ্ছে, জীবন আসলে কতটা ক্ষণস্থায়ী, কতটা ভঙ্গুর। এই হাসপাতালের গেটটা যেন এক জীবন্ত প্রতীক। একদিকে কেউ প্রবেশ করছেন কান্নাভেজা চোখ নিয়ে, প্রিয়জনকে বাঁচানোর শেষ আশায়। অন্যদিকে কেউ সেই একই গেট দিয়ে বের হচ্ছেন চিৎকার করতে করতে, হয়তো হারিয়েছেন তাদের কোনো প্রিয়জন। আবার কেউ কেউ হাসপাতালের গেট দিয়ে প্রবেশ করছেন নতুন জীবনের আনন্দে, নবজাতকের আগমনের সুখবর নিয়ে। একই গেট দিয়ে কেউ হাসতে হাসতে বের হচ্ছেন, হয়তো সুস্থতার আশীর্বাদ নিয়ে। আহা, জীবন! কী অদ্ভুত এই প্রহেলিকা। আমি হাসপাতালের এই পরিবেশে দাঁড়িয়ে প্রতিটি মুহূর্তে জীবন সম্পর্কে নতুনভাবে শিখছি। এখানে প্রতিটি কান্নার শব্দে মনে হচ্ছে, এই পৃথিবীতে আমরা কতটা নগণ্য, কতটা অসহায়। আমাদের সব পরিকল্পনা, সব স্বপ্ন—সবকিছুই যেন এই মুহূর্তগুলোতে অর্থহীন হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে আমি দেখছি, এখানে কেউ জীবনের একান্ত শেষ প্রান্তে এসে থেমে যাচ্ছেন, আবার কেউ জীবনের নতুন শুরু করছেন। আমার চারপাশের এই দৃশ্য যেন এক গভীর বাস্তবতা তুলে ধরছে। জীবন আর মৃত্যুর এই চক্র আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে, সময় কতটা মূল্যবান। এই চার দিনে আমি উপলব্ধি করেছি, জীবনের সবকিছুই অস্থায়ী। হাসপাতালের প্রতিটি করিডোর, প্রতিটি কান্না আর হাসির মিশ্রণ যেন জীবনের পরম সত্যকে সামনে নিয়ে আসে। এই পৃথিবীতে আমরা কতটা ক্ষুদ্র, কতটা অসহায়—এই সত্য কখনো এভাবে উপলব্ধি করিনি। প্রতিটি মুহূর্ত যেন আমাকে ভেতর থেকে বদলে দিচ্ছে। আল্লাহর দয়া আর আমাদের প্রার্থনার ওপর নির্ভর করেই আমরা বেঁচে থাকি। এই অভিজ্ঞতা আমাকে আরও বিনয়ী করেছে, শিখিয়েছে জীবনের প্রকৃত মূল্য। জীবনের এই করুণ, আনন্দময় এবং অশ্রুসিক্ত মুহূর্তগুলো যেন আমাকে মনে করিয়ে দেয়—আমরা মানুষ। আমাদের ভালোবাসা, দয়া, সহানুভূতি—এই গুণগুলোই আমাদের মানুষ হিসেবে পরিচয় দেয়। আল্লাহ যেন আমাদের সবাইকে শক্তি দেন এই কঠিন মুহূর্তগুলো সামাল দেওয়ার। জীবনের এই চক্রে, আমি শুধু প্রার্থনা করি, আমার সোনামণি যেন সুস্থ হয়ে উঠে, আর আমি যেন এই জীবনের প্রকৃত অর্থ আরও গভীরভাবে বুঝতে পারি। তারিখ : ১৮/০১/২০২৫ ১২:০৩amsaimunislamrajib
wowo